Tuesday, 19 April 2016

কষ্টকন্যার কাঙ্খিত দিনযাপন...



(ফারিয়া স্মৃতি)
তখন সময়টা ছিল গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। তখন যেমনি গরম পড়ত আবার মাঝেমধ্যে বৃষ্টিও হত। এমন সময়টাতে মাসুদ- ফাইজা দম্পতি তাদের বাচ্চার চিকিৎসার জন্য একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে চার-পাঁচ দিন থাকেন। মাসুদের এক বন্ধু এই ক্লিনিকের মালিক হওয়াই সব দিক থেকে ওদের একটু বেশিই প্রাধান্য ছিল।ওদের বাচ্চার দেখাশুনার জন্য একটি অল্প বয়সী সুন্দরী আয়া নিযুক্ত করা হয়। আয়া মেয়েটি খুব বেশি আন্তরিক ছিল।দেখতে খুবই সুন্দরী,পাতলা গড়ন, হলুদ ফর্সা বর্ণ, নাকের নথটার জন্য ফাইজার চোখে তাকে অনেক মায়াবিনী মনে হয়। সে সবসময় সস্তা প্রসাধনীর মাধ্যমে ফিটফাট থাকার চেষ্টা করত।এই হাস্যোজ্জল মেয়েটি একটু বাচালও বটে। হয়তবা এই গুনটির জন্যই খুব সহজে সেবা গ্রহীতাদের আকৃষ্ট করা যায়। মেয়েটিই প্রথমে অনেক বিনয়ী এবং পরিচিত লোকদের মত করে নানা প্রশ্ন করে। যেমন: বাবুর কি হয়ছে ভাবী?কিভাবে এত ঠান্ডা লাগছে? বাবু কি খাই? এই সেই... ফাইজা ওর সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া শেষ করে ওর নাম জানতে চাওয়াই বলে আমার নাম "রুপেনা" কেবিনের মেঝে ঝাড়ু দিতে দিতে সে জানতে চাই এরপর তাদের জন্য সে কি করবে।ফাইজা আপাতত কিছু নয় বলে জিগ্যেস করে," রুপেনা তোমার বাসা কোথায়? ভাবী তো নাম উল্লেখপূর্বক এক বস্তির কথা বলে। আবার হেসে বলে," আপনি চিনেন?
ফাইজা বলে, না চিনিনা। ঝাড়ু দেওয়ার পর মেয়েটি বাবুর ময়লা জামাকাপড় কাঁচতে বাথরুমে যায়। এই ফাঁকে মাসুদ স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে, " আরে এরা বাজে মেয়ে, চরিত্রহীনা ইত্যাদি। এই আয়ার কাজ ছাড়াও ওদের মত মেয়েদের অনেক পয়সা আসে এসব বাজে কাজ করে " ফাইজা একটু কৌতূহলে জিগ্যেস করে তুমি কি করে জানলে? সব বিষয়ে না জেনে বললে কি করে? " তখন মাসুদ জানায় ওর যে বন্ধু এই ক্লিনিকের মালিক তার কাছ থেকে সে অনেক রসাত্মক গল্প শুনেছে এসব মেয়েদের নিয়ে। ওর বন্ধুদের অনেকেই মালিক বন্ধুর আমন্ত্রনে এখানে আসে। আর ফাইজাকে বলে ওর সাথে অন্যকোন আলাপ না করতে।ফাইজা অবাক হয়ে সব শুনে বলে," ! তার মানে তুমিও.....
মাসুদ বিরক্ত হয়ে বলে," ধূর কি বল! "
মেয়েটি বাথরুম থেকে বের হয়ে মাসুদের চোখে চোখ পড়তেই সে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে তার অনান্য কেবিনে আজকের কাজের তালিকা শুনিয়ে ফাইজাকে বলে আবার প্রয়োজন হলে ডেকে আনার জন্য। এর ফাঁকে আরেকজন বয়স্ক আয়া আসে ফাইজাদের কেবিনে। সব আলাপ পরিচয় শেষে বলে, " খালা পিচ্চির কাজ কি সুন্দরী করে?তার অনেক উপ্তি কামাই আছে। কে জানে এত ট্যাকা দিয়ে যে কি করে....! আমার কথা আবার বইলেন না... ফাইজার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বের হয়ে যায়। আবার কিছুক্ষণ পর রুপেনা গরম পানি করে দিতে আসে।তখন ফাইজা খুব আন্তরিকভাবে বলে, তোমার কি বিয়ে হয়েছে? রুপেনা বিরক্তিমুখে বলে -হয়ছিল আর এই বদমাইশটার জন্যই জীবন শেষ। ফাইজা - কি করে তুমার বর? রুপেনা জানায়- নেশা কয়রা টাল হয়া থাকে, ট্যাকার জন্য মারে। শান্তি পাই না, এখন দিছি জেলে ভইরা,মাসে তিন হাজার গেলে যাক, শান্তিতে তো আছি।" ফাইজা বুঝতে পারে ওর স্বামী মাদকাসক্ত পূনর্বাসনে আছে। রুপেনা হনহনিয়ে ময়লার ঝুড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়।ফাইজা সুযোগ বুঝে অন্যদিন জানতে চায় রুপেনার মা,বাবা, বাচ্চা এবং জীবনের কথা। খুব স্বাভাবিক ভাবে আফসোস করে বলে বাবা ছোট বেলায় মারা যায়।তার আরো তিন ভাই বোন আছে ওর। মায়ের অন্য এক ভিখারীর সাথে বিয়ে হয়। একটু বড় হয়ছে পরে এর ওর বাসায় কাজ করে। বাকি ভাইবোনেরাও নিজেরাই উপার্জন করে খাই। পরে প্রেম করে এই আইসক্রিম ওয়ালার সাথে বিয়ে। এখন উপার্জিত টাকায় সে নিজেও চলে মাকেও কিছু দেয়। এবং স্বামীর চিকিৎসা করছে। তার থাকার ঘরটাতে হাটুজল জমে বর্ষায়। তাই নতুন টা ঘর নেওয়ার কথা ভাবছে। কিন্তু টাকায় হয় না। ছেলেটাকেও মানুষ করা লাগবে। আজও আসার সময় ছেলে তরমুজের কথা বলে দিয়েছে অন্তত ফালি হলেও নিতে হবে। কি আর করবে সব কিছুর যা দাম। এই তিন হাজার টাকার বেতনের চাকরি দিয়ে কি হয়।৫নং রোগীর আজ ছুটি। তারা পারিশ্রমীকের খুশি হয়ে যা দেয়।রুপেনা ঘামে চিপচিপে চিবুক মুছে আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে তাকে এখানে চাকরিটা দিয়েছে ফাইজার স্বামীর বন্ধু। সেই স্যার খুব ভালো মানুষ....ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ফাইজা মনে মনে ভাবে এমন অসহায় মেয়েদেরও সম্মানের বিনিময়ে চাকরি পেতে হয়।আবার এরা নোংরা, চরিত্রহীনা এই উপাধিটুকু ধারন করে দীর্ঘশ্বাসে জীবন কাটাতে হয়। আর সেসব চাকরিদাতারা তো মহানপুরুষ এই সমাজে কিংবা রুপেনাদের চোখে।কারন যেখানে রোপেনাদের কাছে একটু ভালো থাকা, একমুঠো ভাত, একটা ভালো ঘর কিংবা এক ফালি তরমুজ অনেক মূল্যবান আর সস্তা শুধু তাদের সম্মান।
ফাইজা মাসুদের সাথে রুপেনার সমস্ত ঘটনা আলোচনা করে.. মাসুদ কিছুটা বিব্রত হয়। মনে মনে ভাবে তবে কি "রুপো" সব বলে দিলো না তো ফাইজাকে। কারন প্রথম পরিচয় তো আমার সাথেই মেয়েটির। এবং এই রুপো নাম চাকরিটা আমিই দেয়।কিন্তু ফাইজা তো তেমন কোনো কিছু বলছে না। তবে কি কিছুই বলেনি....?মাসুদ অনেক চিন্তিত ছিল।
পরেরদিন ডাঃ তাদের বাবুকে চেকআপ করে এবং তার স্বাস্থ্যের উন্নতি দেখে বাসায় চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়। সব কিছু গোছগাছ করে দিয়ে রুপেনা বাবুকে কোলে নিয়ে বলে- দোয়া করি অনেক বড় মানুষ হও।তোমারও টা ক্লিনিক হোক। আর আমার মত রুপেনা যেন... তখনই ফাইজা বলে ওঠে যাতে খুব নিশ্চিন্তে, নিজের অধিকারের ভিত্তিতে তাদের দু' মুঠো ভাতের জোগান হয় ঐসব ক্লিনিকের ডিউটিতে....... ফাইজা তখন রুপেনার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। হাস্যোজ্জল মেয়েটির মুখে যেন তৃপ্তির আনন্দ ঠিকরে পড়ছিল......মাসুদ কিছুটা অসস্তিকরভাবে শুকনো কাশি দিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে.......

0 comments:

Post a Comment