============ এম মাহমুদ বুলবুল
মনিকাকু ফোনটা রিসিভ করতেই ওপার থেকে “হ্যালো, নিবিড় আছে?” “এই নিবিড়, কই, তাড়াতাড়ি আয়, তোর ফোন” নারীকন্ঠ শুনে মনিকাকুর মেজাজ খারাপ। কদিন আগেই নিবিড় একটা বেওয়ারিশ সীম দাদার ফোনে লাগিয়ে নারীকন্ঠে মনিকাকুর সাথে প্রেমকরে ধরাখেয়ে ধোলাই খেয়েছে।কিন্তু আজ কোন মেয়েমানুষ ফোন দিয়ে ওকে খুজছে! উঠতি বয়স, আর কদিন বাদেই এস এস সি টেষ্ট পরীক্ষা। এরই মাঝে আবার বান্ধবী যোগাড় হয়েছে কিনা কে জানে? মনিকাকু ভাবল, পরে সাইজ করা যাবে।নিবিড়ের মনেও ভয় আছে। দেরী করলেও মনিকাকুর তাড়া খেয়ে এল-
“হ্যালো”
“আমি তোমার আম্মু বলছি ভাল আছ?”
নিবিড় সম্বিৎহারা হয়ে গেল প্রায়।একযুগ পর তার মা তাকে ফোনকরেছে! কন্ঠও অচেনা, মানুষটাতো বটেই। ওর বয়স যখন চার তখন একবার ফোনে কথা হয়েছিল হয়ত তাও মনে নেই। নির্বাক অবোধের মতই কানে ফোন আর চোখ-- বারবার মনিকাকুর দিকে।
“শোন আমি দেশে এসেছি, তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে, আমি খুব অসুস্থতো তাই আসতে পারছিনা। কবে আসবে?”
ওর বয়স যখন এগারোমাস তখন ওর মা ওকে রেখে আমেরিকা চলে গিয়েছিল বিত্তশালী প্রবাসীপ্রেমিকের হাতধরে।অর্থ-বিত্ত-বৈভবের কাছে হেরে গিয়োছল ওর বাবা--এমনকি সন্তানও।আকাঙ্খা,অভিলাষ কোন নারীর কত উচ্চ হতে পারে তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ ওর জন্মদাত্রী।
“ কি হলো , কথা বলছ না কেন?”
“কি বলব? আমিতো আপনাকে চিনিনা” ফোনটা এগিয়ে দিয়ে মনিকাকুকে বলল “উনি নাকি আমার আম্মু ! আপনি কথা বলেন”
দুজনেরমধ্যে যা কথা হল তার সারাংশ এই যে, তিনি ১৫ দিনের জন্য দেশে এসেছেন্, এরমধ্যে যেন নিবিড় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে ।
দাদীই ওরকাছে মায়েরমতন । মায়ের কাছথেকে সন্তান যা পায়; তা ও পেয়েছে দাদীর থেকে। প্রাপ্তিতে মা ডাকছাড়া কোনকিছুরই কমতি নেই। যদিও ৪/৫ বছর বয়সপর্যন্ত ওর বাবা-কাকাদের সাথে দাদীকেই মা বলে ডাকত।
কয়েকদিনযাবৎ মনখারাপ । প্রতিদিনই ওর মা ফোনকরে ওকে ঢাকায় আসতে বলে ।সবাই ওকে যাওয়ারজন্যে উৎসাহ দিলেও ওর তেমন প্রতিক্রিয়া নেই । দাদী বললেন “ কিরে তুই যাবিনা? যা সোনাভাই, হাজার হলেও মা তো!”
“কেন যাব? মা হলে তিনিইতো ছুটে আসতেন, কই তাতো হয়নি ! তারপরও আব্বু যদি বলে তবে যেতে পারি ” বলেই বেরিয়ে গেল। ক্ষোভ, কষ্ট, যন্ত্রনার ছবি ষ্পষ্টহয়ে উঠল চোখমুখে ।
পরিবারের সকলেই একটাব্যাপারে একমতছিল যে, তারা কখনই ওকে ওর মা সম্পর্কে খারাপ ধারণা দেবেনা ।এমনকি ওর বাবাও । পাছে ও নারী-বিদ্বেষী হয়েযায় এই ভয়ে। এখন এক নতুনভয় ওর আব্বুকে দিশেহারা করে তুলল—যেতে দিলে বা নাদিলে তার প্রভাব কি হতেপারে এইভেবে । শেষে এইভেবে মত দিল যে , অন্তত হাশরেরদিনে ওর পাওনা বুকেরদুধের হিসেবটা চাইতেওতো তাঁকে চেনা দরকার।তাছাড়া দেখে আসুক-না; স্তন্যপানের দুষ্টুমিতে কামড়লাগার অপরাধে যিনি ওকে কখনও লাথিমেরে কখনওবা ছুড়েফেলতেন কোলথেকে —তাঁকে!
মনিকাকুকে সঙ্গে নিয়ে নিবিড় ঢাকায় এল।ঠিকানা অনুযায়ী বাসায় প্রবেশকরতেই ৪/৫ জন মহিলারমাঝে কে যে মা তা চিনতে না পেরে ওরা দুজন ঠায় দাড়িয়ে। পশ্চিমা-পোষাক পরিহিতা ভদ্রমহিলার চোখে জল! এগিয়ে এসে জড়িয়েধরে কান্নাজড়া কথা- “কোন কষ্ট হয়নি তো! তুই এতবড় হয়ে গেছিস! আয়, আয়-- বোস।” নিবিড় ফ্যালফ্যাল করে শুধু চেয়ে দেখল।
রাত ৯টা বেজে গেছে।খাওয়ার টেবিলে সবাই।বাসায় ওর নানীও আছেন। নানা কথা চলছে হঠাৎ কানে এলো “ তোর বাপকেতো তুই চিনিস না, ওর মত ছোটলোক দুনিয়াতে নেই। আর তোর দাদা-দাদী--- ওরা কি মানুষ নাকি? বস্তির জানোয়ারদের মধ্যে থেকে থেকে কি অবস্থা হয়েছে তোর।” ওর নানী বলে উঠল “ চুপকর, ওরা যদি অতই খারাপ তাহলে ১৬ বছর পর তোরসাথে দেখা করার জন্য কি আসতে দিত?” ইতিমধ্যে ফোন বেজে উঠল, চোখেরজল উবে হাসিতে পরিনত হল “হ্যালো দাদা, হ্যা হ্যা, অবভিয়াসলি, জাস্ট দশটায় আমি চলে আসব, গেষ্টরা সবাই আসছেন তো?”
রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠছিল দুই চাচা-ভাতিজার, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। আর খেতে পারল না। টেবিল থেকে উঠে হাতমূখ ধুতে ধুতে বলল “আমরা কোথায় ঘুমাবো?” “এখন ঘুমাবে কেন? চল গল্প করি, তারপর ঘুমাবে,”
ফোনটা ছিল ঢাকার একজন প্রকাশকের। নিজের লেখা বইয়ের আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচনের জনই মূলত উনি এসেছেন। তারই অনুষ্ঠান কাল সকালে।মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বই। যদিও উনার জন্ম ৭৮’এ।অনুষ্ঠানে দেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিকরাসহ কয়েকজন উচ্চপদস্হ আমলাদেরও আসবার কথা।নানি বললেন “ কাল নিবিড়কে সাথে করে নিয়ে যাবি তো!” “আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?কেউকি জানে যে আমার ছেলে আছে?তাছাড়া এরকম হাইপ্রোফাইল ইভেন্টে ওদেরকে নিলে আমার প্রেষ্টিজ বলে কিছু থাকবে?” নিবিড় কথাগুলো শুনেছে, মনে পড়ল কয়েকদিন আগের ‘নারী মায়েরজাতি’ বিষয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতার কথা।তার পক্ষের তার্কিক হয়ে রানারআপ হয়েছিল। চ্যাম্পিয়ন না হতে পারার মনোকষ্ট কিছুটা প্রশমিত হতে লাগল।
বহু চেষ্টার পরও নিবিড় আম্মু ডাকতে পারল না। দু-একবার অষ্পস্ট ডাকার চেষ্টা করেনি তা-নয়। কোথায় যেন বেধে যায়। হয়ে উঠছে না। পরদিন অনুষ্ঠান শেষে বেলা ২টায় বাসায় ফিরে ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে বেরোলেন ফ্যান্টাসী কিংডম-এ, ফিরলেন ৮টায়। ফ্রেশ হয়ে সবাই এক সাথে বসে গল্প করছেন। “আমরা কাল বাড়ী যাব, আমার টেষ্টপরীক্ষার আর মাত্র ২দিন বাকী”। “আচ্ছা সে হবে, আমি তোমার জন্যে একটা গিফট এনেছি চল ওটা নেবে” বলতে বলতে নিবিড়ের হাত ধরে নিয়ে গেলেন বেড়রুমে। ব্যাগ থেকে একটা ফোন সেট বের করে দিলেন ওর হাতে। সেটটা বের করার সময় অসাবধানতা বশত তার পাসপোর্টটি পড়ল মেঝেতে। হাতে উঠালো নিবিড়। খুলে দেখলোও। হঠাৎ ফোলানো বেলুন ফুটো হয়ে গেলে যেমন চুপসে যায় তেমনই অবস্থা হল ওর।“এই নিন” পাসপোর্টটি দিয়ে পাশের টেবিলে থাকা ফটো এ্যালবামটা নিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল এরা কারা?
“এইটা আমার মেয়ে, আর ইনি ওর আব্বু”
“উনারা আসেন নি?”
“না, মেয়েটা বাবার পাগল, ওর আব্বু খুব ব্যাস্ত তাই আসতে পারিনি, শোন- আমি তোমার কাছে নেই বলে ভেবো না, তোমাকে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই। তোমাকে আমি আমার কাছে নিয়ে যাব। এদেশে কোন মানুষ থাকে নাকি! ফকিরের মত বাচার কোন অর্থ নেই। পরেরবার এসে তোমাকে নিয়ে যাব, তুমি রেডি থেকো। আর এ টাকাটা রাখো পছন্দের কোন কিছু কিনে নিও” কথাগুলো গড়গড় করে বলতে বলতে ৫হাজার টাকা দিলেন। নিতে না চাইলেও মনিকাকুর ধমকে হাতে নিল নিবিড়।
ঘুম আসছিল না, প্রবোধভান্ডারে নতুনকিছু যোগ হচ্ছে। য়েখানে রয়েছে—শিশুকালে বাবার বুকেরউপর শুয়েথেকে পাওয়া “ আম্মু কিনে আনতে হয়, আমরা ঢাকা থেকে কিনে নিয়ে আসব,খুব ভালো-আম্মু,বড় নাহলে কেনা যায়না বাবা,এখন ঘুমাও” আরো পরে সবার কাছথেকে পাওয়া “ ভালোভাবে লেখাপড়া কর, রেজাল্ট ভালো নাহলে কিন্ত ভালো আম্মু পাওয়া যাবেনা”। ভাবতে লাগল- এতদিন আমি কিভাবে ছিলাম, যারা আমাকে এতটা বড় করে তুলেছেন, যিনি আমাকে মাতৃস্নেহ দিয়েছেন তাদের কোন কথাই উনিতো শুনলেন না,১৬ টি বছরের মধ্যে উনি আমার খোজও নিলেন না অথচ তাঁর মমতা এতবেশী যে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে মহাপরিকল্পনা করছেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠে তৈরী হল বাড়ি যাওয়ার জন্যে, নাস্তার টেবিলে ওর কথায় নিস্তব্ধ হল সবাই “ আচ্ছা আপনিকি আমার আব্বুকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন?আমিতো জানতাম দেননি।যদিও এখন আর দরকার নেই ।”
মনিকাকুকে সাথে নিয়ে বাইরে এসে রিক্সায় উঠল বাসষ্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। মনেরমধ্যে ছবি ভেসে উঠছে পাসপোর্টটার পাতাটার। ওতে যে নামটা দেখলাম সেটা তো আমার মায়ের নাম নয়! আমার মায়ের নাম তো জোসনা খানম। দুটি নাম রিক্সার চাকার মতই ঘুরতে থাকল মনের মাঝে---।বৃষ্টি নেমেছে , কেউই রিক্সার হুট তুললোনা।ভিজছে, প্রশান্তি নাকি বিষাদে কে জানে !
0 comments:
Post a Comment