কালো মেয়ের গল্প

তরু পরিবারের সবার ভীষণ আদরের একটি মেয়ে। লেখাপড়ায় অনেক ভাল, শান্ত, লক্ষ্মী, ভদ্র মেয়ে হিসেবে সবার কাছেই সে পরিচিত। এত কিছুর পরেও সে সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতো, কারন সে কালো। কোন বিয়ে বাড়িতে কিংবা কোন প্রোগ্রামে যেতে চাইতো না, সবার মন রাখতে প্রোগ্রামে গেলেও এক কোনে চুপ করে বসে থাকতো, কলেজ, প্রাইভেট কিংবা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হতোনা। তার বিকেলটা কেটে যেত ছাদে হাঁটাহাটি করে কিংবা ঘরের ভিতরে বসে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখে ..!!
পাশের বাসার ভদ্র মহিলা প্রায়সময় তরুর মায়ের কাছে এসে গল্প করে তার মেয়ের জন্য লন্ডন আমেরিকা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসছে।এমন ভাবে কথা গুলা বলে যার প্রতিটা কথাই তরুর মাকে মনে করিয়ে দেয় যে আপনার একটা কালো মেয়ে আছে । আচ্ছা কিছু মহিলা এত খারাপ হয় কেন । মনে প্রাণে সে চায় যাতে পাশের বাসা ভদ্র মহিলা তাদের বাসায় না আসুক কিন্তু সেটা সম্ভব না তাকেতো আর মুখের উপর না করে দেয়া যায়না । তরুদের বাসায় তেমন কোন বিয়ের প্রস্থাব আসেনা যাও দুয়েকটা আসে তাও আবার যৌতুক চায় । তার বাবা সাফ না করে দেয় যৌতুক দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেবেনা। যৌতুকের বিয়েতে সংসারের শান্তি আসেনা কারন তারা মেয়েকে বিয়ে করেনা বিয়ে করে টাকাকে .... !!!
মেয়েরা যখন কলেজ ছুটির পর বিশেষ কারও জন্য অপেক্ষা করতো, বিশেষ কোন দিনে যখন হাতে হাত রেখে তারা ঘুরতে যেত । তখন তরুরও ইচ্ছে হতো কারো জন্য অপেক্ষা করতে, কারো হাতে হাত রেখে ঘুরতে যেতে .. একটা ছেলেকে তরুর অনেক ভাল লাগে কিন্তু সেটা তাকে বলা সম্ভব না কারণ একটা কালো মেয়ের কাউকে ভাল লাগতে নেই। তাদের যদি কেউ বিয়ে করতে রাজি হয় সেটাই ভাগ্য । হোক সেই ছেলে বেকার, সেই ছেলের আগে একটা বিয়ের রেকর্ড থাকলেও সমস্যা নেই ... !!!
বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে সে কান্না করে । কেউ সেই কান্না দেখতে পায়না কেউ সেই কান্না শুনেতে পায়না। মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপনে দেখা যায় ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করে অনেক মেয়ে ফর্সা হয়। সেও কিছু প্রডাক্ট ব্যবহার করে দেখেছে কোন লাভ হয় না সব মিথ্যা । কিছু ন্যাকা টাইপের মেয়ে আছে দেখতে সুন্দর হওয়ার পরেও বলে জানেন দেখতে আমি একটুও সুন্দর না ! তখন তরুর অনেক অনেক রাগ লাগে । তার ইচ্ছে করে যদি এই সব মেয়েদের সত্যি সত্যি কালো করে দেওয়া যেত তাহলে বুঝতে পারত কালো হওয়ার যন্ত্রনা কত... !!
ওর বয়সী ‘সুন্দরী’ মেয়েরা যা নিঃসংকোচে হাসতে হাসতে করে,ওর জন্য তা নিষেধ,চরম অপমানকর,লজ্জার। মেয়েটি ভুলক্রমে রাস্তায় হেসে ফেললে পাশ থেকে শোনা যায়,“নিজের চেহারা আয়নায় দেখেছো একবার?” সব জায়গায় যখন সুন্দর মেয়েদের গায়ের রঙের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তখন কারও নজরেই পড়েনা ঘরের কোনায় বসে থাকা মিষ্টি হাসির অপূর্ব সুন্দর মায়াময় চোখের সেই কাল মেয়েটির দিকে । সবার মাঝে থেকেও তাই মেয়েটির আড়ালে থাকতে চাওয়া..!!
এভাবেই কাটতে লাগলো তরুর জীবন। এতসব এর মাঝেও সে কিছু ভাল বন্ধু পেয়েছে, মেয়েটি কালো এই পরিচয়টি ওদের কাছে কখনোই গুরুত্ব পায়নি বরং একটু একটু করে মেয়েটিকে তাদের বিভিন্ন মন্তব্য,আচার-আচরণে ওরা বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে ও ফেলনা নয়। শুধু গায়ের রঙই যে একটি মেয়ের পরিচয় নয়,সত্যিকার সৌন্দর্য যে আসলে মনের সৌন্দর্য সেটা ওদের কাছ থেকে শিখলো তরু ।তার প্রতি ওদের এই সহজ আচরন,শর্তহীন ভালবাসা তাকে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসী করল। হাসতে শিখল সে,নিঃসংকোচে পথ চলতে শিখল,হাজার মানুষের ভীড়ে ওদের একজন হয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে মিশে যেতে শিখে ফেলেছে এখন....!!
.
.
.
বাউণ্ডুলে......